কোন ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে কি না তা প্রশ্ন হিসেবে খুবই ছোট। কিন্তু এর উত্তর দেওয়া একটি কঠিন ব্যাপার। কেন কঠিন তা বিশদ ভাবে সবার জানা উচিৎ।
(১) ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT)
(২) ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS)
(৩) রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS)।
ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয় করার জন্য সাধারণত ৩ টি পদ্ধতি অনুসরন করা হয়।
(১) ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT)
(২) ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS)
(৩) রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS)।
আমরা জানি, কারো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সকালে খালি পেটে ৭.০ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশী হলে অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ শরবত খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে ১১.১ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশী হলে আমরা তাকে ডায়াবেটিস রোগ বলি। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগীর রক্তের রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS) পরীক্ষা করে বলে দেওয়া হয় ঐ ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে অথবা নেই। ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয় পদ্ধতি হিসেবে RBS কখনও নিশ্চিত পরীক্ষা নয়। এই পরিক্ষার মাধ্যমে শুধুমাত্র ধারনা পাওয়া যেতে পারে, এর বেশী কিছু না। তবে কারো যদি অজান্তেই উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিস থেকে থাকে, তাহলে RBS পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা দেখে ডায়াবেটিস সনাক্ত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, নিশ্চিত হবার জন্য OGTT পরীক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশে সাধারনত রোগীরা বিকেল বা সন্ধ্যায় চিকিৎসককে দেখিয়ে রক্ত পরীক্ষা করান। দুপুরে খাওয়ার পর বিকেল বা সন্ধ্যায় রক্ত পরীক্ষা করাতে গেলে অনেকটা সময় পেট খালি থাকে। এতে করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এমনিতেই কমে যায়, যার ফলে RBS পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পরার সম্ভাবনা কম থাকে। যদি সকালে খালি পেটে অথবা সকালে নাস্তার ২ ঘণ্টা পরে অথবা দুপুরের খাবারের ২ ঘণ্টা পরে পরীক্ষা করেন তাহলে ডায়াবেটিস ধরা পরার সম্ভাবনা কিছুটা বেশী থাকে। মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস রোগী না হলে ঐ সময়গুলোতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অবশ্যই স্বাভাবিক থকবে। আর ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে মাত্রা বেশী পাওয়া যাবে। রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS) পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা ১১.১ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশী পেলে সম্ভবত তার ডায়াবেটিস আছে, ৫.৫ মিলিমোল/লিটার – ১১.১ মিলিমোল/লিটার এর ভিতরে থাকলে ডায়াবেটিস অনিশ্চিত, ৫.৫ মিলিমোল/লিটার এর নীচে থাকলে ডায়াবেটিস নেই বলে ধরে নিতে হবে। প্রথম দুই ক্ষেত্রে নিশ্চিত হবার জন্য OGTT পরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে, ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) পরীক্ষা RBS এর চেয়ে অনেক বেশী ইঙ্গিতবহ। কারো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সকালে খালি পেটে ৭.০ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশী হলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ডায়াবেটিস হয়েছে। যদি, FBS ৬.১-৬.৯ মিলিমোল/লিটার ভিতরে থাকে তাহলে ইম্পায়ার্ড ফাস্টিং গ্লুকোজ (IFG) হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। অর্থাৎ, ঐ ব্যাক্তির ডায়াবেটিস হয়নি কিন্তু হওয়ার পথে। ডায়াবেটিস নির্ণয় করার জন্য বিশ্ব স্বীকৃত পদ্ধতি হল OGTT (Oral Glucose Tolerance Test)। এক্ষেত্রে সকালে খালি পেটে একবার রক্ত দিতে হয় এবং ২৫০-৩০০ মিলিলিটার পানিতে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ মিশিয়ে শরবত বানিয়ে খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে আবার রক্ত দিতে হয়। এভাবে, খালি পেটে অথবা গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে – যে কোনটার রিপোর্টে গ্লুকোজের মাত্রা বেশী পাওয়া গেলে তাকে ডায়াবেটিস হিসেবে গন্য করতে হবে। সকালে খালি পেটে (মিলিমোল/ লিটার) গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘন্টা পর (মিলিমোল/ লিটার) সিদ্ধান্ ৭.০ বা তার বেশী ১১.১ বা তার বেশী ডায়াবে আছে ৭.০ এর নীচে ৭.৮ থেকে ১১.১ এর নীচে ইম্পায়ার্ড গ্লুক টলারে (IGT) ৬.১ থেকে ৭.০ এর নীচে ৭.৮ এর নীচে ইম্পায়ার্ড ফাস্টিং গ্লুক (IFG) ৬.১ এর নীচে ৭.৮ এর নীচে স্বাভাবিক (ডায়াবে নেই) এখানে, IGT এবং IFG কে প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা বলা হয়। অর্থাৎ, রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা IGT এবং IFG পর্যায়ে থাকলে ঐ ব্যক্তির সহসাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে কতগুলো নিয়ম মানলে ডায়াবেটিস সহজে হবে না। যেমনঃ (১) ফাস্ট ফুড জাতীয় খাদ্য বর্জন করুন। যথাসম্ভব ঘরে তৈরী খাদ্য গ্রহণের চেষ্টা করুন। ঘরে তৈরী খাদ্যে অতিরিক্ত তেল-চর্বি বাদ দিতে হবে। যেমনঃ তেলের/ ঘিয়ের পরোটার পরিবর্তে শুকনা আটার রুটি খেতে হবে, গরু-খাসীর মাংশ রান্নার আগে সব চর্বি ফেলে দিতে হবে, মুরগীর চামড়া খাওয়া যাবেনা, তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত মাছ বর্জন করতে হবে। কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক এগুলো যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। তিন বেলার খাবারকে ভাগ করে যদি ৫ বারে খাই তাহলে উপকার পাওয়া যাবে অর্থাৎ (ক) সকালের নাস্তা (খ) সকাল ও দুপুরের খাবারের মাঝামাঝি সময়ে হালকা নাস্তা (গ) দুপুরের খাবার (ঘ) বিকালে নাস্তা এবং (ঙ) রাতের খাবার (২) দৈনিক দুই বেলা আধা ঘন্টা করে দ্রুত হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। খালি পেটে এবং খালি পায়ে হাঁটবেন না। (৩) অতিরিক্ত ও অসময়ের ঘুম ত্যাগ করতে হবে। (৪) উচ্চতা অনুযায়ী আপনার ওজন যতটুকু হওয়া উচিৎ তার থেকে বেশী মেদ-ভুঁড়ি বা ওজন থাকলে তা কমিয়ে সমান করতে হবে। (৫) ধূমপান, মদ্যপান বা সাদাপাতা-জর্দা দিয়ে পান খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে। এগুলো কড়াকড়ি ভাবে মানতে পারলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা কমে যায়। অনেকে OGTT পরীক্ষায় ৩ বার রক্ত পরীক্ষা করেন – (১) সকালে খালি পেটে (২) গ্লুকোজ শরবত খাওয়ার ১ ঘণ্টা পরে (৩) গ্লুকোজ শরবত খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে। এক্ষেত্রে ২ বার রক্ত পরীক্ষা করালেই যথেষ্ট – (১) সকালে খালি পেটে এবং (২) গ্লুকোজ শরবত খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে। প্রশ্রাবে গ্লুকোজ (গ্লাইকোসুরিয়া) থাকলে অনেকে মনে করতে পারেন তার ডায়াবেটিস হয়েছে। আসলে তা না। ডায়াবেটিস ছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে প্রশ্রাবের সাথে গ্লুকোজ যেতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই OGTT পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিবেন। অনেকে নিজের বাসায় বা কোন ফার্মেসী থেকে গ্লুকোমিটার দিয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করান। যাদের এখনো ডায়াবেটিস হয়নি অথবা ডায়াবেটিস আছে কিনা জানা নেই, তাদের জন্য গ্লুকোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস আছে কি নেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ না। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাঁরা গ্লুকোমিটার দিয়ে সবসময় বাসায় পরীক্ষা করে দেখবেন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা। মনে রাখবেন, গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করলে তা ১৫% কম বা বেশী দেখাতে পারে। গ্লুকোমিটার দিয়ে আমরা সরাসরি লাল রক্ত থেকে গ্লুকোজ মাপি, কিন্তু প্যাথলজী সেন্টার গুলোতে রোগীর কাছ থেকে রক্ত নিয়ে রক্তের রস (প্লাজমা) আলাদা করে সেখান থেকে গ্লুকোজ পরীক্ষা করে। তাই এটি অনেক বেশী নির্ভুল হয়। কারো ডায়াবেটিস ধরা পড়লে গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1c) পরীক্ষা করাতে হবে। গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1c) গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1c) হিমোগ্লোবিনের একটি রূপ, যা প্রাথমিকভাবে রক্তে দীর্ঘ সময়ের গড় গ্লুকোজ ঘনত্বকে বোঝায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দীর্ঘদিন স্বাভাবিক থাকলে HbA1c এর পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেকদিন ধরে বেশী থাকলে HbA1c এর পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারনত বিগত ৩ মাস রক্তের গড় গ্লুকোজের মাত্রা কম না বেশী ছিল তা HbA1c এর পরিমাণ থেকেই বোঝা যায়। কোনও ডায়াবেটিস রোগীর উচ্চ মাত্রার HbA1c থাকা প্রমান করে যে, বিগত মাসগুলোতে সঠিকভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ডায়াবেটিস রোগীর উচ্চ মাত্রার HbA1c বিভিন্ন ডায়াবেটিক জটিলতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত যেমনঃ হৃদরোগ (Cardiovascular Disease), কিডনীর রোগ (Nephropathy), চোখের রোগ (Retinopathy) ইত্যাদি। রক্তে উচ্চ মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে তা লোহিত কনিকার হিমোগ্লোবিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিনে রূপান্তরিত হয় এবং ঐ লোহিত কনিকা যতদিন বেঁচে থাকে, গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন নিয়েই বেঁচে থাকে। প্রতি ৩ মাস পর পর HbA1c পরীক্ষা করা উচিৎ। বর্তমানে HbA1c কে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়াবেটিস চিকিৎসার একটি মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। এর মাত্রার তারতম্য অনুসারে চিকিৎসায় পরিবর্তন আনতে হয়। ডায়াবেটিস রোগীর গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1c) এর স্বাভাবিক মাত্রা ৭% এর নীচে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ৬.৫% এর নীচে এবং ডায়াবেটিক শিশুদের জন্য ৮.৫% এর নীচে (০-৬ বৎসর), ৮% এর নীচে (৬-১২ বৎসর) এবং ৭.৫% এর নীচে (১২-১৮ বৎসর)। সাধারনত মুখে খাওয়ার ঔষধের চেয়ে ইনসুলিন ব্যবহারকারী ডায়াবেটিক রোগীদের HbA1c এর মাত্রা তুলনামূলক ভাল থাকে। বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায়, নতুন ধরনের এমন কিছু মুখে খাওয়ার ঔষধ আছে যা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি HbA1c কমাতে বেশ কার্যকর। কোন কোন গবেষক বলেন, ৩ মাস পর পর যদি অন্তত ২ বার HbA1c এর মাত্রা ৬.৫% এর উপর থাকে তাহলে তার ডায়াবেটিস থাকতে পারে বলে ধরে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে OGTT পরীক্ষা করিয়ে ডায়াবেটিস আছে কি না, নিশ্চিত হওয়া উচিৎ। GCT জিসিটিঃ গর্ভকালীন মায়েদের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানার জন্য GCT নামে একটি পরীক্ষা পদ্ধতি আছে। দিনের যে কোন সময়ে (খালি বা ভরা পেট যে কোন ভাবে) মা’কে ৫০ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানোর ১ ঘণ্টা পরে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ৭.৮ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে বেশী হলে তাকে GCT পজিটিভ হিসেবে ধরে নিতে হবে। GCT পজিটিভ হলে অবশ্যই OGTT পরীক্ষা করতে হবে।