পুলিশ ইচ্ছে করলেই কেউকে যখন তখন তল্লাশি বা গ্রেফতার করতে পারেন না। পুলিশি তল্লাশি বা আটক তথা অহেতুক হয়রানি থেকে মুক্ত থাকার জন্য নাগরিকদের কিছু পূর্ব প্রস্তুতিও রাখতে হবে। যেমন নিজের পেশাগত পরিচয়পত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা। এছাড়া চেনা জানা দায়িত্বশীল ব্যক্তির নাম, ফোন নাম্বার ও ঠিকানা সঙ্গে রাখা যেতে পারে। বেআইনি কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়া এবং বেআইনি কোনো বস্তু বা মালামাল না রাখা। দেশের বিদ্যমান আইন-কানুন মেনে চলা।
বর্তমান সময়ের প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী পুলিশ কোন নাগরিকের বাড়ি তল্লাশি করতে পারে দুইভাবে-
প্রথমত: আদালত হতে ইস্যুকৃত তল্লাশি পরোয়ানা (Search warrant) থাকলে, (ফৌ.কা. ধারা-৯৬, ৯৮, ৯৯ক, ১০০)
দ্বিতীয়ত: কোন মামলা সংক্রান্তে বা কোন মালামাল উদ্ধার কাজে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা কোন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে আইনসঙ্গতভাবে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার অথবা তল্লাশি করতে পারে। । (ফৌ.কা. ধারা-৪৭ এবং ১৬৫ দ্রষ্টব্য।)
দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দুই ধরনের কর্মকর্তা নিজে সরাসরি উপস্থিত থেকেও এই গৃহতল্লাশি করতে পারেন। কিংবা লিখিতভাবে অপর কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে তা করার অনুরোধ জানালে সেই কর্মকর্তাটিও তাদের পক্ষ থেকে এই গৃহতল্লাশি পরিচালনা করতে পারবেন। উল্লেখ্য যে, কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে ও গৃহতল্লাশির ক্ষেত্রে আইনের ধারা-৪৭ প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে তল্লাশি অফিসারকে কোন নির্দিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ধারা-১৬৫ অনুসারে শুধুমাত্র দায়েরকৃত মামলা সংক্রান্তে কোন মালামাল উদ্ধারের জন্য সেই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অথবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা এই দুই কর্মকর্তা কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোন কর্মকর্তা ছাড়া এ তল্লাশি আর কেউ করতে পারবেন না।
যে সব আইনের অধীনে পুলিশ তল্লাশি করতে পারেন:
- মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-এর ৩৬ ধারা মোতাবেক যদি কোন স্থানে মাদক দ্রব্য লুকানো আছে বলে পুলিশ জানতে পারেন, তবে (ইন্সপেক্টর পদের নিচে নয়) পুলিশ অফিসার বিনা পরোয়ানায় ঐ স্থানে তল্লাশি করতে পারেন।
- পুলিশ আইনের ২৩(৮) ধারা মোতাবেক পুলিশ কর্তব্যরত অবস্থায় যে কোন জুয়ার আড্ডা, সরাইখানা বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে পারেন।
- আফিম আইনের ১৪ ধারা মোতাবেক কনষ্টেবল এর চেয়ে উপরের যে কোন পুলিশ অফিসার আফিম উদ্ধারের জন্য বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালাতে পারেন।
- সরকারী অফিস গোপনীয় আইনের ১১(২) ধারা মোতাবেক পুলিশ বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালাতে পারেন।
- এছাড়াও জুয়া আইনের ৫ ধারা, বিস্ফোরক আইনের ৭ ধারা, আফগারী আইনের ৬৭ ধারা, অস্ত্র আইনের ৩০ ধারার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য।
- উপরে উল্লেখিত ধারা মোতাবেক পুলিশ অফিসার বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালাতে পারেন ।
- ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১০২, ১০৩ ও পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল (পিআরবি) প্রবিধান-২৮০ তে পুলিশের তল্লাশির দায়িত্ব এবং নাগরিকের অধিকার স্পষ্ট করা বলা হয়েছে।
কোনো স্থান বা বাড়ি তল্লাশির ক্ষেত্রে করণীয়:
যদি পুলিশ কোনো স্থান বা বাড়িতে তল্লাশি করতে আসেন তাহলে তল্লাশির পূর্বে পুলিশ ওই এলাকার গণ্যমান্য দুই বা ততোধিক ব্যক্তিকে ডাকবেন এবং উক্ত তল্লাশিতে সাক্ষী হতে বলবেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাদের একজনের প্রতি লিখিত আদেশ দিতে পারবেন। এরপর সাক্ষীদের উপস্থিতিতে পুলিশ ওই বাড়ি বা স্থানটি তল্লাশি করবেন। তল্লাশি শেষে আটক জিনিসগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবেন এবং তালিকাটিতে সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেবেন। তবে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তল্লাশিতে সাক্ষীদেরকে যদি আদালত বিশেষভাবে সমন দিয়ে তলব না করে তাহলে উক্ত সাক্ষীদের আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া যাবে না।
এছাড়াও তল্লাশিকৃত স্থানের দখলকারী ব্যক্তি অথবা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তিকে তল্লাশির সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি দিবে পুলিশ। উক্ত দখলকারী ব্যক্তি বা তার পক্ষে প্রতিনিধি অনুরোধ করলে সাক্ষীদের স্বাক্ষরযুক্ত আটককৃত মালামালের তালিকার একটি নকল দিতে হবে।
যদি তল্লাশিযোগ্য কোনো স্থান বন্ধ থাকে বা মুক্তভাবে প্রবেশ করা না যায় তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা পুলিশ ভেতরের বা বাইরের দরজা-জানালা ভেঙে প্রবেশ করতে পারবেন। ওই জায়গায় যদি কোনো ব্যক্তি থাকে তাহলে তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন।
কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশির ক্ষেত্রে করণীয়:
বর্তমানে আমাদের দেশে যেভাবে ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধিতে এ ধরনের তল্লাশির সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩(৪) ধারায় বলা হয়েছে, কার্যবিধি ১০২(৩) ধারা অনুসারে কোন ব্যক্তিকে সার্চ বা তল্লাশি করা যাবে। উক্ত ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে বস্তুর কারণে তল্লাশি হওয়া উচিত, উক্ত স্থানে বা স্থানের নিকট কোন ব্যক্তি ঐ বস্তু তার শরীরে লুকিয়ে রেখেছে বলে যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যায়, তা হলেও উক্ত ব্যক্তিকে সার্চ করা যেতে পারে।’
অর্থাৎ যে জিনিসটি পুলিশ তল্লাশি করছে তা যদি ওই ব্যক্তির শরীরের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে বলে সন্দেহ হয় তাহলে ওই ব্যক্তিকে পুলিশ সন্দেহ করতে পারবে। উক্ত ধারায় এটাও বলা হয়েছে, সন্দেহ করা ব্যক্তি যদি মহিলা হয় তাহলে অন্য আরেকজন মহিলা দ্বারা কঠোর শালীনতার মধ্য দিয়ে তল্লাশি করতে হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২ ধারা অনুযায়ী মহিলাদের দেহ তল্লাশির সময় নিন্মে লিখিত বিষয়গুলো খুব সতর্কতার সহিত পালন করতে হবে:-
- মহিলাদের দেহ তল্লাশি মহিলা পুলিশ দিয়েই করাতে হবে; পুরুষ পুলিশ কোনভাবেই কোন নারীকে তল্লাশি করার অধিকার রাখে না।
- দেহ তল্লাশির সময় সব শালীনতা রক্ষা করতে হবে। সে সময় কোন পুরুষ লোক সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না।
- মহিলা পুলিশ না থাকলে স্থানীয় কোন মহিলাকে দিয়ে তল্লাশি করাতে হবে।
- সন্দেহকৃত কোনো স্থান বা বাড়ির তল্লাশির জন্য যেমন দুই বা ততোধিক গণ্যমান্য ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে থাকতে হয় ঠিক তেমনি ব্যক্তির তল্লাশির ক্ষেত্রেও তা অবশ্যই পালনযোগ্য। ব্যক্তির কাছ থেকে আটককৃত জিনিসের একটি তালিকা করবে পুলিশ এবং ওই ব্যক্তি চাইলেই তাকে একটি নকল দিতে হবে।
১০৩ ধারায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, লিখিত আদেশ দ্বারা আহবান জানানো সত্ত্বেও যে ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তল্লাশিতে উপস্থিত না হয় ও সাক্ষী হতে অস্বীকার বা অবহেলা করেন, তিনি দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছেন বলে ধরা হবে।
তল্লাশির আগে করণীয়:
- তল্লাশি কাজে স্বাক্ষী হওয়ার জন্য ২/৩ জন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে আহ্বান করতে হবে।(ফৌঃ কাঃ১০৩ ধারা, পিআরবিঃ ৪৬৫ নিয়ম)
- কোনো গৃহে বা আবাস স্থলে তল্লাশি করার জন্য বাড়ীর মালিকের অনুমতি নিতে হবে। (ফৌঃ কাঃ ১০২(১) ধারা।)
- যে স্থান তল্লাশি করা হবে সেই স্থানে পর্দাশীল মহিলা থাকলে তাদের শালীনতা বাজায় রেখে সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা কোন অপরাধজনক বস্তু নিয়ে পালিয়ে না যায়।
- দায়িত্বরত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ তল্লাশি কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
- বাড়ীর মালিক ও সাক্ষীদের সামনে যারা তল্লাশি করবেন তাদেরও শরীর তল্লাশি করে দেখাতে হবে।(ফৌঃ কাঃ ১০৩ ধারা, পিআরবি ২৮০ নিয়ম।)
- কোনো গৃহে বা আবাস স্থলে তল্লাশি করার সময় বাড়ীর মালিককে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে যে ঐ স্থানে কোন ক্ষতিকর বস্তু আছে কিনা।
তল্লাশির সময় করণীয়:
- কোনো গৃহে বা আবাস স্থলে তল্লাশি কালে বাড়ীর মালিককে সঙ্গে নিয়ে তল্লাশি করতে হবে ।(ফৌঃ কাঃ ১০৩(৩) ধারা।)
- পরোয়ানায় উল্লেখিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে তল্লাশি করা যাবে না।(ফৌঃ কাঃ ৯৭ ধারা।)
- যে বস্তুটির জন্য তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে সেই বস্তুটি যদি কারো শরীরে লুকানো আছে বলে সন্দেহ হয় তাহলে তার শরীরও তল্লাশি করা যাবে।
- নারী হলে নারী পুলিশ দ্বারা তল্লাশি করাতে হবে।(ফৌঃ কাঃ ১০২(৩) ধারা, ফৌঃ কাঃ ৫২ ধারা।)
- বে-আইনীভাবে তল্লাশি কালে কাউকে হয়রানী ও বিরক্ত করা যাবে না। (পিআরবি ২৬০ নিয়ম।)
- বাদীকে সঙ্গে রাখা যাবে না ।
- পরোয়ানায় উল্লেখিত বস্তু ব্যতীত অন্য কোন বস্তু নেওয়া করা যাবে না। (ডিএমপি অধ্যাদেশ ৫১,৫২ ধারা।)
তল্লাশির পরে করণীয়:
- তল্লাশি করে কোন বস্তু উদ্ধার করা হলে ৩ কপি জব্দ তালিকা তৈরি করে সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিয়ে বাড়ীর মালিককে এক কপি, কোর্টে এক কপি এবং থানায় এক কপি জমা দিতে হবে। (ফৌঃ কাঃ ১০৩(২),১০৩(৩) ধারা।)
- তল্লাশি করে কোন কিছু না পাওয়া গেলেও তিন কপি জব্দ তালিকা করে সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিতে হবে।
- উদ্ধারকৃত মালামালের গায়ে লেবেল লাগাতে হবে। (পিআরবি ৩৭৯ (খ) নিয়ম।)
- তল্লাশি করা শেষে পুলিশ নিজেকেও সাক্ষীদের সামনে পরীক্ষা করে দেখাবে।
- তল্লাশি করা শেষে জব্দ তালিকা ছাড়া অন্য কোন মালামালে পুলিশ কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করে নি এই মর্মে একটি ডকুমেন্ট বাড়ীর মালিক ও সাক্ষীদের নিকট হতে নিতে হবে।
উপরে উল্লেখিত কার্যক্রম এর ক্ষেত্রে বা তল্লাশিকালে অব্যশই ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০২,১০৩,১৬৫,১৬৬ ধারা, পিআরবি ২৮০ বিধি অনুসরণ করতে হবে।